বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ


বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ

   আমরা সাধারণত বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকে বাংলা সাহিত্য বলে থাকি। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন--
বাঙ্গালা দেশে বাঙ্গালা-ভাষী জন-সমষ্টির মধ্যে, দেশের জলবায়ু ও তাহার ফল স্বরূপ এই দেশের উপযোগী বিশেষ জীবন যাত্রার পদ্ধতিকে অবলম্বন করিয়া, এবং মুখ্যত প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের ভাব ধারায় পুষ্ট হইয়া, গত সহস্র বৎসর ধরিয়া যে বাস্তব, মানসিক আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাই বাঙ্গালী সংস্কৃতি; এবং এই সংস্কৃতি, বাঙ্গালা ভাষার সৃষ্টিকাল হইতে বাঙ্গালা ভাষায় রচিত যে সকল কাব্যে-কবিতায় ও অন্য সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে তাহাই বাঙ্গালা সাহিত্য। 
এই মতটিই সর্বজন গ্রাহ্য।
     বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছর বা তার কিছু অধিক সময়ের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের এই হাজার বছরের অধিক কালের ইতিহাস কে মনে রাখার সুবিধার্থে বা কালের প্রবাহ কে স্বীকার করে নিয়ে কয়েকটি যুগ বা প্রর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারি। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সাল তারিখের হিসেব স্পষ্ট যুগ বিভাগ করা যায় না। সাল তারিখ দেখে যুগের আরম্ভ হয় না, যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটেনা। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ নির্ধারিত হয়েছে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কে প্রধানতঃ তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে।
১। প্রাচীন যুগ বা আদিযুগ (৭৫০-১২০০) ,
২।মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০) ও 
৩।আধুনিক যুগ (১৮০১- বর্তমান সময় পর্যন্ত) ।
প্রাচীন যুগ :
   ভূদেব চৌধুরীর মতে মতে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগ বা প্রাচীন যুগের সময়সীমা ৭৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আদি মধ্য যুগের প্রাচীনতম ও একমাত্র গ্রন্থ হল "চর্যাপদ"।
মধ্য যুগ :
 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের বিস্তার ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের শুরুতে ১২০১ থেকে -১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে কোন কোন গবেষক বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করে থাকেন। কারন এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। তাই ১৩৫১ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ ধরা হয়ে থাকে। মধ্য যুগকে আবার দুটি উপবিভাগে ভাগ করা হয় যথা- আদি মধ্যযুগ(১৩০১-১৫০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১ - ১৮০০)। আদি মধ্য যুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলির মধ্য প্রথমের উল্লেখ করা যায় বড়ু চণ্ডীদাসের "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন"। এছাড়াও কৃত্তিবাসের "রামায়ণ", মালাধর বসুর "শ্রীকৃষ্ণবিজয়" বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল কাব্য প্রভৃতি আদি মধ্যযুগের নিদর্শন। অন্ত মধ্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শন গুলি হল মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল, বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ, ভারতচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গল ইত্যাদি।
   মধ্যযুগের আবার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব। মনে করা হয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে নবজাগরণ হয়েছেছিল তা এই চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করেই। এই জন্য কেউ কেউ একে ' চৈতন্য রেনেসাঁস' বলে থাকেন। বিশেষত মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের স্বরূপ নির্ধারণ করতে গেলে চৈতন্যদেবকে একটি মেইল স্টোন বলা যেতে পারে। তাই শ্রীচৈতন্যের প্রভাব ও ধারা অনুসারে মধ্যযুগের বিভাজনকে অন্য তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ), চৈতন্য যুগ
(১৫০১-১৭০০) ও চৈতন্য পরবর্তী যুগ (১৭০১-১৮০০)। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগকে আবার প্রাক্-চৈতন্য যুগ, চৈতন্য যুগকে চৈতন্য সমসাময়িক যুগ এবং চৈতন্য পরবর্তী যুগকে চৈতন্য উত্তর যুগও বলা হয়।
     প্রাক চৈতন্য যুগের নিদর্শন - শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলি সাহিত্য। চৈতন্য যুগ বা চৈতন্য সমসাময়িক যুগের নিদর্শন হল চৈতন্যজীবনী কাব্য "চৈতন্যভাগবত", বিভিন্ন বৈষ্ণব শাস্ত্র ও তত্ত্বগ্রন্থ। চৈতন্য পরবর্তী বা চৈত্তন্যোত্তর যুগের নিদর্শন গুলি হল আরাকান ও রোসাঙ রাজসভার কাব্য, বিভিন্ন অনুবাদ কাব্য, পদাবলি সাহিত্য, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি।
আধুনিক যুগ:
  আধুনিক যুগ বলে বাংলা সাহিত্যে স্পষ্ট যুগবিভাগ নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। তা হলেও মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন। বিষয় ও বৈশিষ্টের ভিত্তিতে আধুনিক যুগকে আবার দু ভাগে ভাগ করা যায়
১. উন্মেষ পর্ব (১৮০১-১৮৬০ খ্রী.)
২. বিকাশ পর্ব (১৮৬১ - বর্তমান)।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা করেন উইলিয়াম কেরী ও তার সহযোগী সংস্কৃত পন্ডিতেরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয়। এর পর একেএকে আগমন ঘটে রামোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের মতো সব চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল বাঙালি সাহিত্যিকদের।
সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা সাধারণত সুনির্দিষ্ট কোনো সন-তারিখ মেনে হয় না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের শুরু প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরা হয়। এ যুগ নানা দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল।
এই যুগেই সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধাণ শাখা গুলি যেমন -- প্রবন্ধ, নাটক, প্রহসন, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতি। অধুনিক যুগেই বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়ে উঠেছে  সুবিখ্যাত ও সমাদৃত।

To See the Original Post Click Here

আলোচক:  সুশান্ত কর্মকার
এডমিন, সাকসেস বাংলা
গ্রন্থপঞ্জি:
(১) বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিকথা - শ্রীভূদেব চৌধুরী (১ম খণ্ড)।
(১) বাংলা সাহিত্য পরিচয় - ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
(৩) বংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
(৪) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা - ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়।

8 comments:

  1. Thank you so much.I am being helped from this post..

    ReplyDelete
  2. Thank you so much.I am helpful from this post.

    ReplyDelete
  3. পোস্টটি পড়ে উপকৃত হয়েছি৷ ধন্যবাদ৷

    ReplyDelete
  4. খুবই মনোমুগ্ধকর।

    ReplyDelete
  5. ধন্যবাদ, দাদা। পোস্টটি পড়ে উপকৃত হয়েছি৷

    ReplyDelete

Powered by Blogger.